ঢাকা, রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১১ জ্বিলক্বদ ১৪৪৫

রাজধানী ঢাকা থেকে হারিয়ে যাওয়া দিলখুশা প্রাসাদ



রাজধানী ঢাকা থেকে হারিয়ে যাওয়া দিলখুশা প্রাসাদ

নিজস্ব প্রতিবেদক: দিলখুশা ছিল ঢাকার নওয়াবদের একটি বাগানবাড়ি। বর্তমান বঙ্গভবন এবং সংলগ্ন উত্তরের বিরাট জায়গা নিয়ে বিস্তৃত এ স্থানে এককালে মির্জা মুহম্মদের রঙমহলও ছিল। এর ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হতো একটি খাল যা সংস্কারের পর হ্রদে পরিণত হয়। ১৮৬৬ সালে নওয়াব খাজা আবদুল গণি জনৈক ই.এফ স্মিথ থেকে বাগানের পশ্চিমাংশের জায়গাটি ক্রয় করে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র খাজা আহসানুল্লাহর ব্যবহারের জন্য একটি বাগানবাড়ি তৈরি করেন। 

এর নাম দেন দিলখুশা। নওয়াব আহসানুল্লাহ ১৮৭৭ সালে বাগানের পূর্বাংশের ১৫ বিঘা জমি ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির নিকট থেকে লিজ নিয়ে এর সীমানা বৃদ্ধি করেন। পরে সরকারের কাছ থেকে পল্টন এলাকায় আরও ৮০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে কোম্পানি বাগান নামে একটি পার্ক তৈরি করেছিলেন।

দিলখুশা বাগানবাড়ি চারদিকে দেয়াল দিয়ে সুরক্ষিত ছিল। এখানে ছিল লাল রঙের একটি দ্বিতল প্রাসাদ যাতে নওয়াব আহসানুল্লাহ জীবনের একটা বড় অংশ কাটিয়েছেন। ১৮৮৮ এর ঘূর্ণিঝড়ে আহসান মঞ্জিল ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি পরিবার পরিজনসহ প্রায় তিন বছর এখানে বসবাস করেন। পরবর্তীতে তিনি তাঁর কন্যা মেহেরবানু ও জামাতা খান বাহাদুর মুহম্মদ আজমকে বসবাসের জন্য প্রাসাদটি দান করেন। বাগানবাড়ির দক্ষিণে আহসানুল্লাহ ১৮৭৩ সালে একটি বিশাল দিঘি খনন করেছিলেন যা দানা-দিঘি নামে পরিচিত। দিঘির শানবাঁধানো ঘাটের উপর একটি সুন্দর হাওয়াখানা ছিল। এর অদূরে ছিল মানুক হাউস নামে একটি বৃহদাকার ও সুদৃশ্য প্রাসাদ। আঁকাবাঁকা লেক, ফোয়ারা, রঙবেরঙের মাছ সম্বলিত চৌবাচ্চা, দেশি-বিদেশি মনোরম বৃক্ষরাজি, ফল ও ফুলের বাগান দ্বারা দিলখুশা বাগানটি সাজানো ছিল। প্রাসাদ চত্বরে বুলবলাইয়া নামে এক সুদৃশ্য টাওয়ার শোভা পেত। এক স্থানে ৩৬.৫৮ মিটার উচু একটি মাটির কৃত্রিম পাহাড় বানিয়ে তার উপর নির্মিত হয়েছিল একটি সুদৃশ্য বাংলো। বাগানের উত্তরাংশে বারোদুয়ারি নামে চতুর্দিকে খোলা ও মেঝে মার্বেল পাথরে মোড়া একটি বৈঠকখানা ছিল। ফুল বাগানের মাঝে সম্পূর্ণ মার্বেল পাথরের তৈরি সুন্দর একটি অষ্টকোণাকৃতির চন্দ্রাতপ ছিল।

বাগানবাড়ির প্রবেশপথের কাছে একটি কৃত্রিম জলাশয়ে পোষা হতো কিছু কুমির। এরপরেই ছিল একটি খোলা মাঠ। সেখানে পরিবারের সদস্যরা খেলাধুলা ছাড়াও শীতকালে ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতা করত। বাগানের উত্তর সীমানা দেয়াল ঘেঁষে পরবর্তীকালে কয়েকটি একতলা ভবন তৈরি করা হয়। এলাকাটি দুজন সুফি সাধকের জন্যও বিখ্যাত। বাগানের পশ্চিম প্রবেশদ্বারের উত্তর পাশে শাহ জালাল দাখিনী (রঃ)-এর মসজিদটি বর্তমানে রাজউক ভবন চত্বরে রয়েছে। মসজিদ আঙিনায় শাহ নিয়ামতউল্লাহর মাজার ছাড়াও নওয়াব পরিবারের কন্যা মেহেরবানু, শওকত আরা বানু, জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দীনের সমাধি রয়েছে। 

সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ঘটনাই এ বাগানবাড়িতে সংঘটিত হয়েছিল। ১৮৮৫ সালে জনৈক ইটালিয়ান পন্ডিত এদেশে সংস্কৃত ভাষা চর্চার মান ও অবস্থা সমীক্ষা করতে আসেন। 

নওয়াব আবদুল গণি এদেশীয় পন্ডিতদের নিয়ে এখানে এক আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। লে. গভর্নর স্টুয়ার্ট বেইলি ঢাকা সফরে এলে ১৮৮৮ সালে এ বাগানে নওয়াব আহসানুল্লাহ তাকে সংবর্ধনা দেন। খ্রিস্ট নববর্ষ উপলক্ষে শাহবাগের ন্যায় এখানেও ১৮৯১ সালে কৃষি- শিল্প মেলার আয়োজন করা হয়। ১৯০২ সালে ছোট লাট উডবার্ন ঢাকা সফরে এসে দিলখুশায় নবাব খাজা সলিমুল্লাহর সঙ্গে আলোচনা করেন। ১৯০৬ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের নবনিযুক্ত ছোটলাট ফুলার সাহেবের স্ত্রী দিলখুশা বাগানে প্রদেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্মানে অভ্যর্থনা সভা করেন। ১৯১৪ সালে লর্ড কারমাইকেল ও তাঁর পত্নীকে এখানে এক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ১৯৪৮ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ ভাসানী এখানে অবস্থিত খাজা নসরুল্লাহর বাড়িতে রাজনৈতিক আলোচনায় মিলিত হন।

১৯০৫ সালে ঢাকা পূর্ববঙ্গ ও আসামের রাজধানী হলে সরকারি দফতর তৈরির প্রয়োজনে বাগানের দক্ষিণাংশ সরকার লিজ নেয়। উত্তরাংশ নওয়াব এস্টেটের অধিকারে থাকে। মাঝখান দিয়ে নির্মিত একটি রাস্তা উভয় অংশকে পৃথক করে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দিলখুশা প্রাসাদের নামানুসারে এলাকার নাম করা হয়। ১৯৫১ সালে জমিদারি উচ্ছেদের পর সংস্কারের অভাবে বাগানবাড়িটি জরাজীর্ণ হতে থাকে। 

পঞ্চাশের দশকের শেষ নাগাদ বাকি অংশ সরকার ও ডিআইটি কর্তৃপক্ষ অধিগ্রহণ করে। ১৯৭৪ সালে ডিআইটি মতিঝিল-দিলকুশা এলাকাকে শতভাগ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য লেআউট প্রণয়ন করে। সেই সুযোগে তৈরি হয় বিশাল বিশাল ভবন। আশপাশ থেকে হারিয়ে যায় সবুজের সমারোহ। পুকুর ঘিরে এলাকাটি গড়ে উঠলেও বর্তমানে কোনো জলাধারই অবশিষ্ট নেই।


   আরও সংবাদ